কবি ও কাঙাল

শক্তি চট্টোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের এক বিস্ময়কর কবি, যিনি উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন ও গভীর চিন্তার মিশেলে সৃষ্টি করেছেন অমর কবিতা। তাঁর লেখায় মেধা, মনন, ও ছন্দের নিখুঁত সমন্বয় দেখা যায়। প্রকৃতির টানে নির্জনে হারিয়ে যাওয়া এই কবি ছিলেন ভালোবাসার কাঙাল, বোহেমিয়ান, এবং সৃষ্টিশীলতার প্রতীক। তাঁর সৃজনশীলতা এবং উদাসীন জীবনধারা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়।

- অংশুমান চক্রবর্তী

থেকে গেলেন অধরা

সান্নিধ্য তো দূর, কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের দর্শনসৌভাগ্যও আমি লাভ করিনি। এ আমার বিরাট আক্ষেপ। ১৯৯৫-এর ২৩ মার্চ, যখন চলে গেলেন, তখন সবেমাত্র ছড়ার উঠোন থেকে একটু একটু করে পা রাখছি কবিতার ঘরে। যদিও তার অনেক আগেই শক্তি চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে জেনেছিলাম। কাঁচা বয়সেই। হাতে এসেছিল একটি সাহিত্য পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা। বাবা কিনেছিলেন। সেই সংখ্যার প্রচ্ছদ কাহিনি ছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবির লড়াই। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। কিছুই বুঝতাম না তখন। তবু টেনে নিয়েছিলাম সংখ্যাটা। কৌতূহলবশত। চোখ রেখেছিলাম পাতায়। তিনটি নামের সঙ্গে আমার সেই প্রথম পরিচয়। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা পড়েছি তার অনেক পরে। প্রথম প্রথম কিছুই বুঝতাম না। আজও যে সম্পূৰ্ণ বুঝি, তা নয়। তবে শুরু থেকেই তাঁর কবিতা ভীষণভাবে টানত। এইভাবেই তাঁর আলোর ছটায় ভিজেছি। বিস্মিত হয়েছি তাঁর কবিতার অলিগলি ঘুরে। তারপর একদিন শুনলাম, তিনি নেই! ঘিরে ধরেছিল মনখারাপ। পরবর্তী সময়ে সামান্য হলেও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সান্নিধ্য পেয়েছি। শক্তি চট্টোপাধ্যায় আমার কাছে থেকে গেলেন অধরা। এই মনঃকষ্ট দূর হবে না কোনওকালেই।

ভেসে বেড়ায় অসংখ্য মিথ শক্তিকে ঘিরে গল্পের শেষ নেই। অসংখ্য মিথ ভেসে বেড়ায় শহর থেকে গ্রামে। এও শোনা যায়, তিনি ছিলেন বোহেমিয়ান, বেহিসেবি, চরম উচ্ছৃঙ্খল। তরলে ডুবে থাকতেন সারাক্ষণ। যদিও তাঁর লেখায় সেইসবের বিন্দুমাত্র প্রভাব দেখি না। কখনও সখনও হয়তো রাস্তায় পা ফেলতে গিয়ে টাল খেতেন, কিন্তু তাঁর কবিতা কোনওভাবেই টাল খায়নি। বলা যায়, তিনি ছিলেন তালে ঠিক। কবিতাই বলা হোক বা পদ্য, লিখেছেন নিখুঁত ছন্দে। ছড়ার হাতটিও ছিল চমৎকার। যে কোনও লেখায় ঘটাতে পারতেন মেধা ও মননের মহাসম্মিলন। যেতেন চিন্তার গভীরে। ছুঁতেন ভাবনার শীর্ষবিন্দু। আশ্চর্য মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন শব্দ প্রয়োগে। মায়াজাল বিস্তার করেছেন ছত্রে ছত্রে। সেখানে তিনি নিখুঁত। দারুণ হিসেবি। উচ্ছৃঙ্খল নন, সুশৃঙ্খল।