তুমি তো আমার রহিবে...

বাঙালির জীবনে অতুলপ্রসাদ সেন কতখানি আছেন? কীভাবে আছেন? প্রেম, ভক্তি, জাতীয়তাবাদ……… জন্মদিনের ১৫০ বছর পার করে আজ কোথায় তিনি, বোঝার চেষ্টা করলেন পায়েল সেনগুপ্ত।

‘ক -দরদান বলতে লখনউয়ের । লোক ঠিক কী বোঝে জানি না, তবে আমি অতুলপ্রসাদকেই বুঝতাম। বাংলাদেশ নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের কাছে চির ঋণী, কিন্তু অতুলপ্রসাদকে লখনউয়ের প্রবাসী করে লখনউ সে-ঋণের প্রতিশোধ করেছে।” সঙ্গীতবিশেষজ্ঞ ধূর্জটিপ্রসা মুখোপাধ্যায়ের অগ্রন্থিত প্রবন্ধ থেকে এই মন্তব্য উদ্ধার করেছেন তাঁর ছেলে কুমারপ্রসাদ। ব্যারিস্টার এপি সেনের নামে লখনউতে একটি রাস্তা রয়েছে। কিন্তু প্রত্যেক বাঙালির মনের গহনে যিনি রাস্তা খুঁজে নিয়েছেন অতুলপ্রসাদ সেন, তাঁর গহনের মধ্য দিয়ে। রবীন্দ্রনাথ না হয় বাদই থাক, বাঙালির প্রিয় নজরুলের থেকেও তিনি প্রায় যোজনখানেক দুরে। কিন্তু সংখ্যাই যে শেষ কথা নয়, একথা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। বাঙালি সেই গানকে বরণ করে নিয়েছে যা সহজ সরল অনাড়ম্বর ধনে ধনী। অথচ প্রায় নীরবেই অতিক্রান্ত হল বাংলা গানের ধারার এক প্রবাদপ্রতিম পুরুষের ১৫০ বছর। রবীন্দ্রসঙ্গীতের পরেই নজরুলগীতি,

অতুলপ্রসাদী, দ্বিজেন্দ্রগীতি, রজনীকান্তের গান...বাঙালির গানযাত্রার নিত্যসঙ্গী ছিল। কিন্তু গান হিসেবে তাদের নাম যত এসেছে, গানের চর্চা বা গানের স্রষ্টাদের বিষয়টিই কোথাও যেন উপেক্ষিতই থেকে গিয়েছে। অতুলপ্রসাদ সেনের অনাড়ম্বর সার্ধশতবর্ষ পার হয়ে যাওয়া কোথাও যেন মনে করিয়ে দেয়, বাংলার নিজস্ব গানের প্রতি, তার গভীরতার প্রতি বাঙালির একধরনের ঔদাসীন্যও রয়েছে। প্রবল এবং অনুপেক্ষণীয় রবিচ্ছায়ায় থেকেও অতুলপ্রসাদ সেন খুঁজে নিয়েছিলেন তাঁর স্বাতন্ত্র্য। মানুষ অতুলপ্রসাদের ছায়া যেন বারবার ঘুরেফিরে এসেছে তাঁর সৃষ্টিতে। কবি, গীতিকার, সুরকার অতুলপ্রসাদ। অতুলপ্রসাদী গানের ওপারে দাঁড়িয়ে যে অতুলপ্রসাদ। তাঁর জীবনের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যাবে সেই জীবনকে অবিরত চাষ করেছে দুঃখ। পিতৃহারা কৈশোরের একমাত্র অবলম্বন বিধবা মায়ের পুনরায় বিবাহ, যা তিনি মেনে নিতে পারেননি। এরই ফলস্বরূপ তাঁর নিঃসঙ্গ বিদেশবাস। প্রবাসে প্রথম সন্তানের মৃত্যু, স্বদেশে ফিরেও পরিজনহীন জীবন। আপাতদৃষ্টিতে নিতান্ত সাধারণ কিন্তু অসাধারণ এক দুর্জয় অভিমানে স্ত্রী হেমকুসুমের সঙ্গে পৃথক বাস। অথচ সঙ্গীতের রসগ্রাহিতায় তাঁর তিনি অতুলনীয়। গান শুনে তিনি ‘উন্মত্ত’ হয়ে যেতেন। এমন একটি ব্যক্তিজীবন সার পেয়েছে তাঁর গানের বাণী, সুর পেয়েছে প্রকৃত ভাষ্য।