বাঙালির সেই গৃহ সহায়করা

এই লেখাটি বাংলার একান্নবর্তী সংসার এবং বনেদি পরিবারের ভৃত্যদের জীবন ও তাদের সাংস্কৃতিক প্রভাব নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত অথচ বিস্তৃত বিবরণ। এটি ঔপনিবেশিক সময়ের সামাজিক পরিবর্তন, কর্মজীবন ও মানুষের আন্তঃসম্পর্কের মর্মান্তিক এবং মজাদার দিকগুলোকে ফুটিয়ে তুলেছে।

- সুরজিৎ ধর

সেকালের বনেদি পরিবার বা একান্নবর্তী সংসারে দেখাশোনার দায়িত্ব সে ছিল একদল পরিচারকের। পাচক, মালি, খানসামা, বাজার সরকার, ঝি, চাকর ইত্যাদি কতই না বিভাগ ছিল। অনেকক্ষেত্রে এদের নিয়োগ করা হতো বংশ পরম্পরায়। আর তাদের বংশলতিকা ছিল মনিব বাড়ির মুখস্থ। সাধারণত মেদিনীপুর আর বর্ধমানের লোকেরাই এই কাজ করে আসত। তবে দারোয়ানের কাজটা ছিল পশ্চিমিদের একচেটিয়া। রোজ গাদাখানেক ছোলা-ঘি আর চিনি সাবড়ে ডন বৈঠক-কুস্তি করে, বিশাল বপু বানালেও কোনও হাঙ্গামা ঠেকাতে ছিল অষ্টরম্ভা। এসব কাজে বরং দেশীয় কৈবর্তরাই ছিল বেশি নির্ভরযোগ্য। দারোয়ানরা থুতনির মাঝে দাড়ি কামিয়ে, দু'পাশে শ্মশ্রুরাশি কাপড় দিয়ে বেঁধে উঁচু করে রাখত। ঘরের কাজের লোকদের এই বাহারি গোঁফ রাখার অধিকার ছিল না। মনিবের সামনে তারা গোঁফ নেড়ে কথা বলবে, এটা ছিল সকলের অসহ্য। তবে গলায় দু’গাছি কণ্ঠী অবশ্যই ধারণ করতে হতো। ইংল্যান্ডের প্রথা অনুসরণ করে পরাধীন ভারতেও এই আজব প্রথা চালু হয়েছিল। শোনা যায়, ১৮৯৭ সাল নাগাদ একদল গোঁফহারা নফর সভা করে, তাদের গোঁফ ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য, এক দরখাস্ত করলেও শেষ পর্যন্ত কী হয়েছিল তা আর জানা যায়নি।

বাপ-ঠাকুরদার আমলের এইসব ‘পুরাতন ভৃত্যের’ সম্মান পরিবারে বিন্দুমাত্র কম ছিল না। ছেলে বা নাতির বয়সি উত্তরসূরিরা তাদের সামনে ধূমপান করত না। সর্বদা আপনি আজ্ঞে বলে কথা বলত। তাদের পুজো বা ব্রতপালন, তীর্থভ্রমণ, দান-ধ্যানের খরচটা সংসার থেকে পেত। মাস মাইনের টাকাটা তাদের ধরাই থাকত। দেশের বাড়িতে আপন ছেলেমেয়ে বা আত্মীয় কুটুম্বের সঙ্গে দীর্ঘ অদর্শনে, সম্পর্কের সুতোটা আলগা হয়ে যেত। তবে মৃত্যুকালে তার জমানো টাকাটা তাদের মধ্যে ভাগ করে দিত। বাংলা সাহিত্যে এই কেষ্টা, রাইচরণদের সঙ্গে ব্যোমকেশ বক্সীর পুঁটিরাম, কিরীটী রায়ের জংলি, আর প্রফেসর শঙ্কুর প্রহ্লাদের কথা কেউ কি ভুলতে পারবে? এখানকার কিছু খ্যাতিমান মনিবের সঙ্গে কয়েকজন ‘কেষ্টা’ ও ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। তাদের কর্মকাণ্ডের কথা আজও খুঁজলে পাওয়া যাবে।