কৌলিন্য প্রথার যুগে কেমন ছিলেন বাংলার মেয়েরা

উনিশ শতকের বাংলায় কৌলিন্য প্রথার অপব্যবহার ছিল সমাজের একটি বড় সমস্যা। একাধিক বিবাহের মাধ্যমে কুলীন ব্রাহ্মণরা নিজেদের মান-সম্মান রক্ষা করতেন, তবে এর ফলে সমাজে নারী-পুরুষের অবস্থা অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রেই মেয়েরা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শারীরিক বিপদে পড়তেন। কৌলিন্য প্রথার কুফল নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হলে, সমাজ সংস্কারকরা এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন, বিশেষত বিদ্যাসাগর ও অন্যান্য পণ্ডিতরা। এই প্রথা বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন পত্রিকা, সমাজসেবী ও ব্যক্তিরা সরব হয়ে উঠেন, যদিও একে রোধ করতে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া তখনও সম্ভব হয়নি।

- জয়ন্তী মণ্ডল

অবশেষে এক কুদর্শন ৬০ বছরের বৃদ্ধ পাত্রের | সঙ্গে জনৈক কুলীন ব্রাহ্মণ তাঁর চার মেয়ের বিবাহ দিলেন। সেকালের পণ্ডিত রামনারায়ণ তর্করত্নের ‘কুলীনকুলসর্বস্ব' নাটকের বিষয়বস্তু। উনিশ শতকে বাংলার সমাজচিত্রটা ছিল এরকমই। সেকালের সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি ঘটনার কথা বলি— “কিয়দ্দিবস হইল বালি গ্রাম নিবাসী গোবিন্দচন্দ্র নামক একজন কুলীন ব্রাহ্মণ একশত পত্নীকে বিধবা করিয়া লোকান্তরগত হইয়াছেন।'

হইয়াছেন। আবার ১২৯৭ অগ্রহায়ণ ‘পরিচারিকা' পত্রিকায় প্রকাশিত একটা খবর হল— ‘সম্প্রতি ১৪ জন কুমারীর সহিত একটি ৬০ বৎসর বয়স্ক কুলীনের একদিনে বিবাহ হইয়া গিয়াছে। ফরিদপুর জেলার অন্তর্গত আমগ্রামের বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের এই ঘটনা হইয়াছে। বরের নাম সর্বেশ্বর, বাড়ি বর্ধমান। কোন দর্শক বলেন, বিবাহের সময় চতুর্দশ কুমারী অর্ধচন্দ্রের আকারে মাথায় ঘোমটা দিয়া সারি সারি পাত্রের চারিদিকে যখন দাঁড়াইল তখন এক অপূর্ব দৃশ্য নয়ন গোচর হইয়াছিল। কুমারীগণের বয়স ৪/৫ হইতে ২২/২৪ বৎসর পর্যন্ত। হঠাৎ শুনিলে এটা গল্প মনে হয়।১ তবে মিথ্যে নয়। ঠিক যেন গল্প !

উনিশ শতক অর্থাৎ এখন থেকে একশো কুড়ি-ত্রিশ বছর আগের কথা। ফরিদপুর জেলার সর্বেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, বা বালির গোবিন্দচন্দ্রের মতো কুলীন ব্রাহ্মণেরা নির্বিচারে এরকম অসংখ্য বিবাহ করতে লজ্জা বোধ করতেন না। নবজাগরণের যুগেও বাংলায় কৌলিন্য প্রথা নামে বহু বিবাহ রমরমিয়ে চলেছিল। হয়তো কোনও কুলীন ব্রাহ্মণের টাকার দরকার অমনি তিনি একটা বিয়ে করে নিতেন। আসলে এসব কুলীন ব্রাহ্মণদের এভাবে অসংখ্য বিবাহ করতে বাধত না। কারণ স্ত্রীর ভরণপোষণের দায় দায়িত্ব তাঁদের ছিল না। তাই এসব কুলীন ব্রাহ্মণেরা কেউ কেউ হাসতে হাসতে কুড়ি থেকে পঞ্চাশটা বিবাহ করে নিতেন। শুধু বিবাহ করেই উদ্ধার করতেন মেয়েদের। সমাজে কৌলিন্য প্রথার চল থাকার ফলে কন্যাদায়গ্রস্ত মেয়ের অভিভাবকেরা এভাবে কুলীন বরের হাতে মেয়েদের বিয়ে দিতে একপ্রকার বাধ্য হতেন। তবে এতগুলি স্ত্রীর সঙ্গে কুলীন পুরুষটি দেখা করতেন কীভাবে?