ক্যামেলিয়া

পড়িমরি করে ছুটে এসেছিলেন দু'জন। প্রবাহ আঙুল তুলে শুধু দেখিয়েছিল ক্যামেলিয়ার দিকে, যার পাতার ফাঁকে ফাঁকে ফুটে ছিল অনেকটা গোলাপের মতো দেখতে গোটা দুই-তিন রক্তলাল ফুল।

- শ্রী জিৎ সরকার

রাতে খেতে বসে যখন খাবার চিবোনোর সঙ্গে সঙ্গে গ্রুপ ভাবগুলোও মনে মনে আউড়ে নিচ্ছিল প্রবাহ, তখনই বাবা তুললেন কথাটা, “ভাবছি, পিছনের ক্যামেলিয়া গাছটা এ বার কেটেই দেব।” মুহূর্তের মধ্যে ‘পুট অফ’ আর ‘টেক অফ’-এর পার্থক্য গুলিয়ে ফেলল প্রবাহ। মুখে থাকা দলা চট করে গিলে নিয়ে এক ঝটকায় সোজা হয়ে বসল ও, “কেন?”

স্টু-য়ে টোস্ট ডোবাতে ডোবাতে জবাব দিলেন বাবা, “গাছটা কেমন বুনো ঝোপের মতো হয়ে আছে না? ফুলটুলও তো কিছু ফোটে না!”

বিষয়টা এতই অপ্রত্যাশিত ছিল যে, চট করে জুতসই কোনও উত্তর জোগাল না প্রবাহর মুখে। ওর মনে পড়ে গেল, আজ থেকে বছর পাঁচেক আগের কথা। যখন ও ক্লাস টু-এ পড়ে, তখন গাছটা এসেছিল এই বাড়িতে। প্রবাহের দাদুর জন্মদিনে, তাঁর এক প্রকৃতিপ্রেমী বন্ধু উপহার দিয়েছিলেন ওটা। গাছটা নিজের হাতে পুঁততে পুঁততে দাদু বলেছিলেন, “বুঝলে তো দাদুভাই, মানুষ এক দিন চলে যায়। কিন্তু তার চিহ্ন আরও কিছু দিন বয়ে যায়।”

পাহাড়ি জল-হাওয়ায় অভ্যস্ত ক্যামেলিয়া কলকাতার গরম আর দূষণে আদৌ কত দিন টিকতে পারবে, সেই সন্দেহ প্রথম থেকেই ছিল। তবে সব আশঙ্কার মুখে ছাই দিয়ে গাছটা টিকে গেল। এই পাঁচ বছরে সে যে দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে বেড়েছে, তাই-ই নয়, গাঢ় সবুজ পাতার বাহারও হয়েছে দেখার মতো। তবে বহু পরিচর্যাতেও সাধের ক্যামেলিয়ায় একটা কুঁড়িও ধরেনি। ফলে তার ফুলের রংটা ঠিক যে কী— লাল, হলুদ, সাদা না গোলাপি, তা আর জানা হয়নি কারও।

প্রবাহ একটা ঢোঁক গিলে বলল, “কিন্তু বাবা, এমনিতে তো ওটা কোনও সমস্যা করছে না...”

মা এত ক্ষণ চুপচাপ সব কিছু শুনছিলেন। এ বার বললেন, “এখন সমস্যা করছে না বটে, তবে পরে যে করবে না, তার কি কোনও নিশ্চয়তা আছে? কোন দিন পাতার আড়ালে মৌমাছিতে বাসা বাধবে, দেখতেও পাব না! শেষে হুল ফুটিয়ে দিলে বিপদের শেষ থাকবে না। তা ছাড়া ও রকম ঝোপঝাড় থেকে মশা-মাছির উৎপাত বাড়ে। তোমার বাবা ঠিকই বলছেন প্রবাহ। ও সব জিনিস কেটে ফেলাই ভাল।”

গ্রুপ ভাব তো অনেক ক্ষণ আগেই দলছুট বাছুরের মতো দূরে চলে গিয়েছিল। উপরি বলতে, যে খাবার একটু আগেও সাংঘাতিক সুস্বাদু মনে হচ্ছিল প্রবাহের, সেটা এ বার সাংঘাতিক তেতো মনে হতে লাগল।